বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি । আদা চাষের উপযুক্ত সময়

প্রতি বছর এদেশের জন সংখ্যা, আবাসনের জন্য ঘর বাড়ি, যোগাযোগের জন্য রাস্তা এবং কলকারখানা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদি জমি। এ পরিস্থিতিতে চাষ অযোগ্য পতিত জমি বা বসতবাড়ির চারদিকে অব্যবহৃত স্থান, নতুন ফলবাগান ও বিল্ডিং এর ছাদে বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।
বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি । আদা চাষের উপযুক্ত সময়
চলুন এই চ্যাপ্টারে বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি, আদা চাষের উপযুক্ত সময় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো এবং আরো জানবো বস্তার জন্য কিভাবে মাটি তৈরি করবেন আদা চাষের সুযোগ সুবিধা কি ইত্যাদি।

ভূমিকা

আদা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল। বাংলাদেশে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ২.৬৮ লক্ষ মেট্রিক টন আদা উৎপাদন হয়। যা দেশের চাহিদার ৪.৮১ লক্ষ মেট্রিক টন এর তুলনায় অপ্রতুল। আদার গড় ফলন ১১.২৮ টন/হেক্টর। এই ঘাটতি পুরনের লক্ষে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণ কিছু জাত আবিষ্কার করেছেন। যেমন; 
  • বারি আদা-১, 
  • বারি আদা-২, ও 
  • বারি আদা-৩ 
এই তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন যার ফলন ৩০-৩৯ টন/হেক্টর। উৎপাদন কম হওয়ার কারন আদা চাষের উপযোগী জমির অভাব এবং কন্দ পঁচা রোগের ব্যাপক আক্রমন হওয়া। কন্দ পঁচা রোগের কারনে আদার ফলন ৫০-৮০ ভাগ পর্যন্ত কম হয়ে যায়।

মাটি ও আবহাওয়া

মাটিতে আদা চাষ করলে বীজ বা মাটির মাধ্যমে কন্দ পঁচা রোগ সম্পূর্ণ জমিতে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু বস্তায় আদ্য চাষ করলে কন্দ পঁচা রোগ হয় না, হলেও জমিতে ছড়িয়ে গড়ার সম্ভাবনা থাকে না। বস্তায় আলা চাষ করে বাংলাদেশে যে আদার ঘাটতি রয়েছে তা সহজেই পূরণ করা সম্ভব। জৈব পদার্থ সম্পৃদ্ধ দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও উচু জায়গা বাড়ায় আদা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

বস্তার জন্য মাটি তৈরি

সিমেন্ট বা অন্য বস্তায় আদা চাষের জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলো একত্রে মিশ্রণ করে আদা রোপনের ১৫-২০ দিন পূর্বে একত্রে পালা/ ডিবি করে পলিথিন দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে যাতে বাতাস প্রবেশ না করে। প্রতি বস্তায় উল্লেখিত পরিমাণে মাটি, জৈবসার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।

আদার ভালো ফলন পেতে হলে প্রথমে মাটি ৮-১০ কেজি প্রতি বস্তায় নিতে হবে। এটা জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে। গোবর ৫ কেজি, ভার্মি কম্পোস্ট ২ কেজি, টিএসপি ১৫ গ্রাম, এমওপি ৬ গ্রাম, ছাই ১ কেজি, কার্বফুরান বা কারটাপ ১০ গ্রাম, জিংক ৫ গ্রাম এবং বোরন ৫ গ্রাম মিশিয়ে নিতে হবে।

মিশ্রণ তৈরীর সময় মাটি, গোবর, ভামি কম্পোস্ট, ছাই, টিএসপি, কার্বফুরান, জিংক, বোরন সব একত্রে মিশিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক এমওপি মিশ্রণ তৈরীর সময় দিতে হবে। অর্ধেক ইউরিয়া, অর্ধেক ডিএপি আদা রোপনের ৫০ দিন পর এবং বাকী অর্ধেক ইউরিয়া এমওপি সমানভাবে দুই কিস্তিতে রোপনের যথাক্রমে ৮০ দিন ও ১১০ দিন পর বস্তায় প্রয়োগ করতে হবে। অর্ধেক ডিএপি সার আদা রোপণের ৬৫ দিন পর বাকী অর্ধেক ডিএপি সার আদা রোপনের ১৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।

বস্তায় আদা চাষের সুবিধা

এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না যে কোন পরিত্যাক্ত জায়গা, বসতবাড়ির চারদিকে ফাঁকা জায়গা, লবনাক্ত এলাকা, বাড়ির ছাদে সহজেই চাষ করা যায়।
  • একই জায়গায় বার বার চাষ করা যায়।
  • এ পদ্ধতিতে অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব।
  • এ পদ্ধতিতে উৎপাদন খরচ অনেক কম। প্রতি বস্থায় ১৬-২০ টাকা খরচ করে বস্তা প্রতি ১-২ কেজি আদা উৎপাদন করা যায়। যার মূল্য ১২০-২৪০ টাকা।
  • এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করলে কন্দ পঁচা রোগ হয়না , যদি কখনো রোগ দেখা যায় তখন গাছসহ বস্তা সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে কন্দপঁচা রোগ ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে না।
  • বস্তায় আদা চাষ করলে নিড়ানি ও অন্যান্য পরিচর্যার তেমন দরকার হয় না ফলে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়।

আদা চাষের উপযুক্ত সময়

এপ্রিল-মে (চৈত্র বৈশাখ) মাসে আদা লাগাতে হবে। তবে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ আদা চাষের উপযুক্ত সময়। এই সঠিক সময়ে যদি আপনি আধা লাগাতে পারেন তাহলে অবশ্যই ভালো ফলন আশা করা যায়। সুতরাং এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই লাগানোর চেষ্টা করবেন।

বস্তায় মিশ্রন ভরাট করা

বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি র ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বস্তায় মিশ্রন ভরাট করা। বস্তায় আদা লাগানোর পূর্বে প্রতি বস্তায় তৈরীকৃত মিশ্রন এমনভাবে ভরাতে হবে যাতে বস্তার উপরের দিকে ১-২ ইঞ্চি ফাঁকা থাকে। এতে বস্তার উপরে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা থাকার কারণে পানি দেওয়ার কাজে সুবিধা হবে এবং নিড়ানি দিতে সুবিধা হবে।

বস্তা সাজানো বা স্থাপন পদ্ধতি

বস্তা সাজানো বা স্থাপন পদ্ধতি তে ৩ মিটার চওড়া ও প্রন্ত সুবিধামত নিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। একটি বেড থেকে অন্য বেডের মাঝখানে ৬০ সেমিঃ ড্রেন রাখতে হবে। ড্রেনের মাটি বেডের উপর দিয়ে বেডকে উচু করে নিতে হবে যাতে বেডে বৃষ্টির পানি জমাট বেধে না থাকে। এর পর প্রতি বেডে ২ টি সারি এমন ভাবে রাখতে হবে যেন এক সারি থেকে অন্য সারির মাঝে ১ মিটার দূরত্ব বজায় থাকে। প্রতি সারিতে ৬-৮ ইঞ্চি পর পর পাশাপাশি ২টি বস্তা স্থাপন করতে হবে।

বীজের আকার ও রোপন পদ্ধতি

প্রতি বস্তায় ৪০-৫০ গ্রামের একটি বীজ মাটর ভিতরে ৪-৫ইঞ্চি গভীরে লাগতে হবে। বীজ লাগানোর পর মাটি দ্বারা ঢেকে দিতে হবে। হালকা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে খুব একটা চাপ দেওয়া যাবে না। মাটিতে ঢেকে দেয়ার কারণ কোন পাখি যেন বীজ নষ্ট করতে না পারে বা কেউ যেন নিয়ে না পারে। এবং মানুষ যেন চুরি না করতে পারে।

বীজ শোধন পদ্ধতি

বস্তায় আদা রোপনের পূর্বে ২ গ্রাম অটোস্টিন বা প্রোভেক্স ২ প্রতি লিটার পনিতে মিশিয়ে এক কেজি আদা বীজ এক ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভেজা আদা পানি থেকে উঠিয়ে ছায়ায় রেখে শুকিয়ে বস্তায় রোপন করতে হবে। আর অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যদি অংকুর গজায় তাহলে আরো ভালো ফলন পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

আন্ত:পরিচর্যা পদ্ধতি

বস্তায় আদা চাষ করলে আগাছা তেমন হয় না। যদি আগাছা প্রথমে দেখা যায় হবে নিড়ানী দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া পরবর্তীতে সার প্রয়োগের সময় মাটি আলগা করে গাছের গোড়া থেকে দুরে সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এবং মাঝে মাঝে লক্ষ্য রাখবেন যাতে পানি সংকীর্ণ না হয় বা আগাছা বেশি না হয়ে যায়।

ফসল সংগ্রহের সময় করণীয়

বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি অনুযায়ী জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে বস্তা থেকে আদা উঠানো হয়। আদা পরিপক্কতা লাভ করলে গাছের পাতা ক্রমশ হলুদে হয়ে কান্ড শুকতে শুরু করে। এ সময় আদা তুলে মাটি ঝেড়ে ও শিকড় পরিস্কার করে সংরক্ষণ করতে হয়। আদা সংরক্ষণ বা সংগ্রহ করার পর অবশ্যই তাহা শুকনা জায়গায় রাখবেন।
আদার ফলন

যদি ভালোভাবে বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি গুলো অবলম্বন করে থাকেন । তাহলে সাধারণত প্রতি বস্তায় জাত ভেদে ১-৩ কেজি পর্যন্ত আদার ফলন পাওয়া যায়। আর এটা বিশেষ করে ২০ সংগ্রহ থেকে শুরু করে পরিচর্যার উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

লেখকের মন্তব্য

আমি পরিশেষে আপনাকে একটি কথাই বলতে চাই। যে আপনি যদি বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি ভালোভাবে পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনার মনে আগ্রহ জাগবে। এবং আমি সাজেস্ট করব আপনি অবশ্যই বিভিন্ন পরিত্যাক্ত জায়গায় বা ছাদে ছায়াযুক্ত জায়গায় বস্তায় আদা চাষ পদ্ধতি টা অবলম্বন করবেন। এতে আপনি একজন উদ্যোক্ত হতে পারেন।

এই পোস্টটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনার নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের সাথে শেয়ার করবেন। যাতে করে তারাও এই উদ্যোগটি নিতে পারে এবং দেশের আদার-ঘাঁটি পূরণ হতে পারে। ধন্যবাদ।
সুত্রঃ
কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

লেকচার বিডির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url